চট্টগ্রাম,(এবিসি ওয়ার্ল্ড নিউজ ২৪ ডটকম) : বর্ণাঢ্য কর্মসূচির মাধ্যমে চট্টগ্রামে যথাযোগ্য মর্যাদায় ও উৎসবমুখর পরিবেশে মহান বিজয় দিবস-২০২৪ উদযাপিত হয়েছে।
জেলা প্রশাসনের আয়োজনে বিজয় দিবসের কর্মসূচি আজ সূর্যোদয়ের সঙ্গে-সঙ্গে শুরু হয়েছে। ডিসি পার্ক’র দক্ষিণ পাশে অবস্থিত মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভে ৩১ বার তোপধ্বনির মধ্যদিয়ে। পরে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়।
চট্টগ্রাম সিটি করপোশেনের (চসিক) মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন প্রথমে স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। পর্যায়ক্রমে বিভাগীয় কমিশনার ড. মো. জিয়াউদ্দীন, পুলিশ কমিশনার হাসিব আজিজ, চট্টগ্রাম রেঞ্জ ডিআইজি মো. আহসান হাবীব পলাশ, জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম, পুলিশ সুপার রায়হান উদ্দিন খান তাদের নিজ কার্যালয়ের কর্মকর্তা কর্মচারীদের নিয়ে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।
পুষ্পস্তবক প্রদান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে চসিক মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, “স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিন”। লক্ষ প্রাণের তাজা রক্ত ও মা, বোনের সম্ভ্রমহানির মাধ্যমে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল। যে লক্ষ্য নিয়ে ৭১ সালে বিজয় অর্জিত হয়েছিল তার ধারাবাহিকতা আমরা রক্ষা করতে পারিনি। যার কারণে গণতন্ত্রের স্বাধীন যাত্রাপথে বার বার আমরা হোঁচট খেয়েছি এখনো খাচ্ছি।
এছাড়া বীর মুক্তিযোদ্ধা, বিভিন্ন সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, বেসরকারি, বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ সর্বস্তরের জনসাধারণ ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।
এ উপলক্ষে সব সরকারি, আধা-সরকারি, বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের স্ব-স্ব ভবনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়।
সকাল ৮টায় বিভাগীয় কমিশনার নগরীর সার্কিট হাউসে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। এসময় পুলিশ কমিশনার হাসিব আজিজ, চট্টগ্রাম রেঞ্জ ডিআইজি মো. আহসান হাবীব পলাশ, জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম, পুলিশ সুপার রায়হান উদ্দিন উপস্থিত ছিলেন।
বেলা ১২টায় চট্টগ্রামের সিনেমা হল সমূহে বিনাটিকেটে ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র প্রদর্শনী এবং জেলার সর্বত্র উম্মুক্ত স্থানে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রমাণ্য চলচ্চিত্র প্রদর্শনী করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধে শহীদের স্মরণে মসজিদ, মন্দির, গীর্জা ও প্যাগোডাসহ বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে দোয়া- মোনাজাত ও প্রার্থনা করা হয়।
দুপুরে নগরের হাসপাতাল, জেলখানা, শিশু পরিবার, ভবঘুরে কেন্দ্র ও বৃদ্ধাশ্রমে উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করা হয়।
বিকেলে জেলা ও উপজেলা সদরের স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের সমাবেশ, ক্রীড়া অনুষ্ঠান, টি- টুয়েন্টি ক্রিকেট টুর্নামেন্ট, নৌকা বাইচ, ফুটবল, কাবাডি, ও হাডুডু খেলার আয়োজন করা হয়। এছাড়াও দিনব্যাপী শিশু পার্ক, ডিসি পার্ক, চিড়িয়াখানা, জাদুঘর শিশুদের জন্য উম্মুক্ত রাখা ও বিনা টিকেটে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা রাখা হয়।
এছাড়া, নগরের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক খান তালাত মাহমুদ রাফিসহ ছাত্রনেতারা।
চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল মডেল হাইস্কুলের অস্থায়ী শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা), বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল- বাসদ, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ চট্টগ্রাম মহানগর কমান্ড, বাসদ (মার্কসবাদী), চট্টগ্রাম মহানগর যুবদল, মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র ট্রাস্ট, উদীচী চট্টগ্রাম জেলা সংসদ, খেলাঘর চট্টগ্রাম মহানগরী, আবৃত্তি সংগঠন বোধন, প্রমা, বাংলাদেশ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, প্রগতির যাত্রীসহ রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন।
এদিকে বেলা সাড়ে ১১টায় চট্টগ্রাম নগরীর শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণে জেলা প্রশাসনের আয়োজনে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহিদ পরিবারের সদস্যদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম’র সভাপতিতে¦ আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন- বিভাগীয় কমিশনার ড. মো. জিয়াউদ্দিন। বিশেষ অতিথি হিসেবে ডিআইজি আহসান হাবীব পলাশ, পুলিশ কমিশনার হাসিব আজিজ, পুলিশ সুপার রায়হান উদ্দিন খান, বীর মু্িক্তযোদ্ধা কামাল উদ্দিন ও বীর মুক্তিযোদ্ধা একরামুল করিম বক্তৃতা করেন। মুক্তিযোদ্ধা ও শহিদ পরিবারের সদস্যবৃন্দ এবং সরকারি বেসরকারি দপ্তরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীসহ অসংখ্য সাধারণ মানুষ উপস্থিত ছিলেন।
এবারের বিজয় দিবসে চট্টগ্রাম জেলার প্রায় ৪০৫জন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহিদ পরিবারের সদস্যদের সংবর্ধনা প্রদান করা হয়।
মহান বিজয় দিবসে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান, ১৩২ মুক্তিযোদ্ধাকে সংবর্ধনা দিয়েছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক)। সকালে থিয়েটার ইনস্টিটিউট চট্টগ্রাম (টিআইসি) মিলনায়তনে এ সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যদের হাতে ক্রেস্ট, সম্মাননা ও সম্মানী তুলে দেন চসিক মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন।
চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজল বারিক, মনিরুল ইসলাম ইউসুফ, ফজল আহমদ, শহীদ আবুল মনসুরের ছোট ভাই ডা. মোহাম্মদ রকিব উল্লাহ। উপস্থিত ছিলেন চসিক সচিব মো. আশরাফুল আমিন, প্রধান শিক্ষা কর্মকর্তা কিসিঞ্জার চাকমা, শিক্ষা কর্মকর্তা মোছাম্মৎ রাশেদা আক্তার প্রমুখ। বিজয় দিবসের প্রথম প্রহরে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট) উপাচার্য ভবনের সামনে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে দিনব্যাপী কর্মসূচীর সূচনা হয়। পরে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে চুয়েট ক্যাম্পাসে শহিদদের কবর জেয়ারত করা হয়। এরপর চুয়েট একাডেমিক কাউন্সিল কক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন- ভিসি অধ্যাপক ড. মাহমুদ আব্দুল মতিন ভূইয়া। এতে সভাপতিত্ব করেন ছাত্রকল্যাণ অধিদপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. মাহবুবুল। বাদ আছর মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে নিহত বীর শহিদদের আত্মার মাগফেরাত কামনায় বিশেষ দোয়া ও মোনাজাত করা হয়। বিজয় দিবসের অন্যান্য কর্মসূচির মধ্যে ছিল- শিক্ষক বনাম শিক্ষার্থী এবং কর্মকর্তা বনাম কর্মচারীদের প্রীতি টি-২০ ক্রিকেট ম্যাচ, শিশু-কিশোরদের উপস্থিত বক্তৃতা, কবিতা আবৃত্তি ও দেশাত্মবোধক গান, শিশু-কিশোরদের পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠান।
এদিকে, বর্তমান আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ‘হয় মাতৃভূমি রক্ষা করবো, না হয় শহীদ হবো’ এমন ঘোষণা দিয়েছেন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি জেনারেল জাহিদুল ইসলাম। সকালে চট্টগ্রাম নগরের দুই নম্বর গেটে ৫৪তম বিজয় দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির চট্টগ্রাম মহানগর আয়োজিত র্যালি শেষে সংক্ষিপ্ত সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি একথা বলেন। তিনি বলেন, আমাদের এই ভূখণ্ডের ইতিহাস বার-বার লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস। এই ভূখণ্ডের ইতিহাস জীবন দেওয়ার ইতিহাস। এই ভূখণ্ডের ইতিহাস স্বাধীনতা-মুক্তির জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ-তিতিক্ষার ইতিহাস।
সমাবেশে বক্তব্য রাখেন- কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা সম্পাদক ডা. উসামা রাইয়ান, কেন্দ্রীয় ছাত্র আন্দোলন সম্পাদক আমিরুল ইসলাম, ছাত্রশিবির চট্টগ্রাম মহানগর দক্ষিণের সভাপতি মু. শহীদুল ইসলাম, মহানগর উত্তরের সভাপতি ফখরুল ইসলাম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সভাপতি নাহিদুল ইসলাম।
চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের উদ্যোগে মহান বিজয় দিবসের আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়েছে। দুপুরে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে ক্লাবের অন্তর্বর্তী কমিটির সদস্য সচিব জাহিদুল করিম কচির সভাপতিত্বে ও ক্লাবের সদস্য শাহনেওয়াজ রিটনের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও প্রবীণ সাংবাদিক মইনুদ্দিন কাদেরী শওকত, অন্তর্বর্তী কমিটির সদস্য মুস্তাফা নঈম ও গোলাম মাওলা মুরাদ বক্তব্য রাখেন। এতে অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি ও বাসস’র চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধান মোহাম্মদ শাহনওয়াজ, সাধারণ সম্পাদক সালেহ নোমান।
অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে প্রেস ক্লাবের সাবেক পাঠাগার সম্পাদক মো. শহিদুল ইসলাম, দৈনিক পূর্বদেশ’র স্পোর্টস এডিটর সাইফুল্লাহ চৌধুরী, বাসসের বিশেষ প্রতিনিধি মিয়া মোহাম্মদ আরিফ, সাংবাদিক ওয়াহিদ জামান মিন্টু, ছাত্র সমন্বয়ক চৌধুরী সিয়াম প্রমুখ। আলোচনা শেষে চট্টগ্রামের বিশিষ্ট শিল্পীদের পরিবেশনায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়।
এর আগে সকালে চট্টগ্রামের জাতীয় স্মৃতিসৌধে মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনাদের প্রতি চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন প্রেসক্লাবের অন্তর্বর্তী কমিটির নেতৃবৃন্দ।